আজ ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রায়পুরা হানাদার মুক্ত দিবস আজ

মো. শাহাদাৎ হোসেন রাজু

আজ ১০ ডিসেম্বর (শনিবার) রায়পুরা হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে সম্মিলিত মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে রায়পুরা উপজেলা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ৩ নং সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে এ অঞ্চল থেকে হটিয়ে নরসিংদীর রায়পুরাকে পাক বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করে। রায়পুরা মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সূচিত হয় বিজয়ের চূড়ান্ত সোপান।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে এদেশের মুক্তিকামি দামাল ছেলেদের আক্রমণের মুখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাক বাহিনী পালিয়ে ঢাকামুখি হতে থাকে। এরপর থেকে প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো অঞ্চল হানাদার মুক্ত হয়। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আসে সেই গৌরবোজ্জ্বল চূড়ান্ত বিজয়।

রায়পুরা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এক অদম্য শক্তি নিয়ে, স্বপ্রণোদিতভাবে। যুদ্ধ অনভিজ্ঞ তরুণ ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতা প্রতিশোধ স্পৃহায় অটুট মনোবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মনোবলই যে অধিকতর শক্তিশালী পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে তার প্রমাণ রেখেছেন উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সারাদেশে পাক হানাদার বাহিনী অসহায় নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর অমানুষিক নির্যাতনের তাণ্ডব চালাতে থাকে ঠিক সে সময় ৭ এপ্রিল রায়পুরায় সংগঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় প্রশিক্ষণ। ১৪ এপ্রিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে রায়পুরা থানা আক্রমণ করা। অস্ত্রগার থেকে লুটে নেয় অস্ত্র। রায়পুরা থানা আক্রমণে অংশ নিয়েছিলেন – রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসাইন, তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি প্রয়াত জালাল উদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগে সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুনূর রশীদ, উপজেলা সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সভাপতি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম, পৌর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল ওয়াদুদ, শহীদ বশিরুল ইসলাম, শহীদ জহিরুল ইসলাম দুদু, প্রয়াত বীরমুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ আলীসহ আর অনেকে।

এদিকে রায়পুরা থানা লুটের খবরে ১৮ মে পাকবাহিনী রায়পুরায় প্রবেশ করে। এতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম, সেই সাথে স্থবির হয়ে পড়ে যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা। ১৮ অক্টোবর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের মির্জানগর ইউনিয়নের বাঙ্গালী নগরে অবস্থিত ৫৫নং রেল সেতুতে পাক সেনাদের সাথে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। দুই ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে ৬ জন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছিল। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে ৩৩ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন- লতিফ কমান্ডার, কমান্ডার জয়ধর আলী, কাজী হারুন, প্রয়াত ইদ্রিস হালদার প্রমূখ।

৭ নভেম্বর পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে বীরের মত যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন রায়পুরার মরজাল গ্রামের সার্জেন্ট আব্দুল বারি, খাকচক গ্রামের এয়ারফোর্সের নুরুল হক এবং রাজনগর গ্রামের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সোহরাব হোসেন। এ ছাড়াও কাজী হারুন-অর-রশিদ, রাজনগর গ্রামের সুবেদার ইপিআর জয়দর আলী ভূইয়া এবং ইদ্রিস হাওলাদারের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে খন্ড খন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঐসব খন্ড যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হন উপজেলার ৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার স্বাক্ষী হয়ে আছে রায়পুরার মেথিকান্দাস্থ গণকবরটি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও মেথিকান্দা রেলওয়ে স্টেশনের উত্তর পাশে থাকা এই গণকবরটি এখনও অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে। সংরক্ষণ না করায় অরক্ষতি এ গণকবরের শেষ চিহ্নটুকু মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারগণ ছাড়াও বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন কমরেড শামসুল হক। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ৭১’র রণাঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে বিশেষ সম্মাননা খেতাবে ভূষিত করা হয় তাদের মধ্যে একজন বীরশ্রেষ্ঠ ও একজন বীরউত্তম সহ রায়পুরা উপজেলায় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ‍্যা ৫ জন ।

মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধে টিকতে না পেরে অবশেষে ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়, আত্মসমর্পণ ও পিছু হটে গিয়ে নরসিংদী হয়ে ঢাকা পলায়নের মধ্য দিয়ে রায়পুরা মুক্ত হয়। এই দিনে রায়পুরাবাসী গভীরভাবে স্মরণ করেছেন- স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ বশির, দুদুসহ আরো অনেককে।

প্রতি বছরই দিবসটি উপলক্ষ্যে রায়পুরায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে উপজেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছরও আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য র‌্যালির আয়োজন করা হয়েছে।

উপজেলা সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আজকের এই দিনটি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যবহন করে। প্রতিবছরের মত এবারও এই দিনে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজগর হোসেন বলেন, রায়পুরা মুক্ত দিবস উপলক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

     এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ