নিজস্ব প্রতিবেদক
নাম আসাদুজ্জামান আসাদ। বেলাব উপজেলার মাটিয়াল পাড়া (বাগান বাড়ি) এলাকার আব্দুর রাজ্জাক ওরফে রেজু মুন্সির ছেলে এই আসাদ। এলাকায় তাকে সবাই সুদি আসাদ নামেই চিনে।
মেসার্স চিশতী পোল্ট্রি এন্ড ফিসফিড নামে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছে সুদ বাণিজ্য। অতি মুনাফাখোর সুদি আসাদ বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সুদে টাকা কর্জ দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে তাদের হাজতবাস সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে টাকার পাহাড় গড়ে কোটি কোটি টাকার মালিকসহ হয়েছেন সম্পদশালী। তার খপ্পরে পড়ে উপজেলার প্রায় অর্ধ শতাধিক ব্যবসায়ী ব্যবসা-বানিজ্যসহ ভিটেমাটি খোয়া দিয়ে আজ সর্বশান্ত।
সরেজমিনে উপজেলার শিমুলতলী, চন্দনপুর বটেশ্বরসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সুদি আসাদ এলাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে তার নিয়োগকৃত দালাল চক্রের মাধ্যমে প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্প সুদে টাকা নিতে উৎসাহিত করে। টাকা নেওয়ার সময় কৌশলে তাদের কাছ থেকে জামানতের নামে স্বাক্ষর করা সাদা চেক ও রেভিনিউ স্ট্যাম্প জমা রাখে। এরপরই শুরু হয় তার প্রতারণা। সে সাদা স্ট্যাম্পে তার ইচ্ছেমত টাকার অঙ্ক বসিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কয়েকগুণ অতিরিক্ত টাকা আদায় করে। তার চাহিদা মাফিক সেই টাকা দিতে কেউ অস্বীকার করলে তার কাছে জমা থাকা স্বাক্ষর করা চেকে মোটা অংকের টাকা ও তারিখ বসিয়ে ব্যাংক ফেরত চেক দেখিয়ে ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা ঠুকে দেন। আর এভাবেই একের পর এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সুদের পাশাপাশি প্রতারণার মাধমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে টাকার পাহাড় গড়ে হয়েছেন কোটি কোটি টাকা ও সম্পদের মালিক। তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অনেক ব্যবসায়ী বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন। আবার অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সুদি আসাদের প্রতারণার শিকার চন্দনপুর গ্রামে মৃত খন্দকার গোলাম মোস্তফার ছেলে সুজন খন্দকার নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি ব্যবসার কাজে আসাদের কাছ থেকে তার শর্ত মোতাবেক স্বাক্ষরিত দুটি ব্ল্যাঙ্ক চেক ও স্ট্যাম্প জমা রেখে মাসিক ৫০ হাজার টাকা সুদে ১০ লাখ টাকা কর্জ নেই। কিছুদিন যেতে না যেতেই সে আমার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা দাবি করে বসে। পরে তার প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে আপোষ মিমাংসা করে ৫ মাসে সুদ সমেত ১৭ লক্ষ টাকা তার ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করি। যার সকল প্রমাণাদি আমার কাছে রয়েছে। আমি তার সব টাকা পরিশোধ করার পরেও সে আমার স্টাম্প ও চেক ফেরত দেওয়া নিয়ে গড়িমসি করতে থাকে। পরবর্তীতে আবারও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আমার কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করে। আমি দাবীকৃত সেই টাকা দিতে অস্বীকার করায় সে তার সুদি ব্যবসায়ীক পার্টনার ইয়াবা মামলার আসামী হারুনের যোগ সাজশে ৪৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা দাবি করে জমাকৃত আমার একটি চেক ডিসওনার দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে। সেই মামলা আদালত থেকে দ্রুত গ্রেফতারি পরোয়ান বের করিয়ে আমাকে গ্রেফতার করায়। একদিন হাজতবাসের পর ২৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা আদালতে জামানত হিসেবে জমা দিয়ে আমি জামিনে মুক্ত হই।
জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর অপর চেকটিতে ৩৭ লাখ ৪০ টাকার অংক বসিয়ে তা ডিসওনার দেখিয়ে তাইজুল ইসলাম নামে তারই অপর এক সহযোগীকে দিয়ে ওই টাকা দাবী করে উকিল নোটিশ পাঠায়। তার এই প্রতারণামূল আচরণে আমি তার বিরুদ্ধে আদালতে একটি জালিয়াতি মামলা দায়ের করেছি। এই আসাদ আমার মতো বহু ব্যবসায়ীকে প্রতারণার মাধ্যমে পথে বসিয়েছে খোঁজ নিলে তা জানতে পারবেন।’
সুমন খন্দকার নামে অপর এক যুবক বলেন, আমি আসাদের কাছ থেকে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা লাভে এনে সুদে-আসলে ৯ লাখ ১০ হাজার টাকা ফেরত দেওয়ার পরও সে আমার চেক ও স্ট্যাম্প ফেরত দেয়নি। বর্তমানে সে আমার বাছে আরো টাকা দাবি করছে।
বটেশ্বর গ্রামে ব্যাবসায়ী খলিলুল্লাহ তপন বলেন, পোল্ট্রি ফিড নেওয়ার সুবাদে প্রায়ই আমার দোকানে আসাদের যাতায়াত ছিল। আসাযাওয়ার মাঝে একদিন সুযোগ বুঝে সে ক্যাশ ডয়ার থেকে আমার স্বাক্ষর করা একটি চেক চুরি করে নিয়ে যায়। চুরি করা সেই চেক দিয়ে আমার কাছ থেকে ২৬ লাখ টাকা দাবি করে আদালতে মামলা দায়ের করলে ঝামেলা এড়াতে এলাকাবাসীর মধ্যস্থতায় ১৫ লাখ টাকা দিয়ে আপোষ মীমাংসা করি।
আনোয়ার হোসেন সবুজ নামে অপর এক ব্যক্তি বলেন, আমার পিতার মৃত্যুর পর আসাদ পিতার কাছে ঋণ বাবদ ১ লাখ টাকা পাওনা বলে আমার কাছে তা দাবি করে। আমি তার কাছে সেই ঋণের প্রমান চাইলে সে কোন ধরনের প্রমান দেখাতে পারেনি। একদিন বেলাব বাজার থেকে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আমাকে জোরপূর্বক তার অফিস যেটাকে অনেকে তার টর্চার সেল বলে সেখানে নিয়ে যায়। খালি স্ট্যাম্পে আমার স্বাক্ষর ব্যর্থ হয়ে আমাকে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এই নির্যাতনে আমি ১৫ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম।
কাউছার আহমেদ চপল নামে অপর একজন বলেন, আসাদের কাছ থেকে আমি সুদের উপর ১ লাখ টাকা নিয়ে এ পর্যন্ত আড়াই লাখ টাকা দিয়েও তার প্রতারণা গাত থেকে মুক্ত হতে পারিনি। সে আরো টাকার দাবী করছে অন্যথায় আমাকে মামলার হুমকি দিচ্ছে।
মো. ওমর ফারুক নামে অপর এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমি গত ৩ মাস আগে আসাদের কাছ থেকে মাসে ১০ হাজার সুদে ১ লাখ টাকা এনে তিনমাসে মোট ৩০ হাজার টাকা সুদ পরিশোধ করি। সে বর্তমানে আমার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা দাবি করছে। টাকা না দিলে আমার নামে মামলার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
বাজনাব ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য করিম খন্দকার বলেন, সুদি আসাদের পাতানো ফাঁদে পড়ে এবং প্রতারণার শিকার হয়ে বহু ব্যবসায়ী ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে এলাকার সাধারণ মানুষ অসহায়। তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পায় না। কেউ মুখ খুললে সে তাকে পুলিশ ও তার লালিত বাহিনী দিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে।
এ দিকে এই প্রতিবেদক সুজন খন্দকারকে সাথে নিয়ে উকিল নোটিশ পাঠানো তাইজুল ইসলামের কাছে গিয়ে হাজির হয়। তিনি যার নামে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে সেই সুজনকে তিনি চিনেন কিনা জানতে চাইলে তিনি এর কোন সদোত্তর না দিয়ে এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে ওই স্থান থেকে কেটে পড়েন।
বেলাব উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক ইব্রাহিম বাদলের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে সুদি আসাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আসাদের সাথে হয়তো আমার চেনা জানা আছে তবে তার সুদের ব্যবসার বিষয়টি আমার জানা নেই।
এ ব্যাপারে আসাদের সাথে কথা বলতে বেলাব বাজার হাজির হলে, সবার হিসাব তার খাতায় লেখা আছে। সে হিসাব দেখানোর জন্য বাজারে একটি দালানের দোতলায় একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে তালা খুলতেই বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, গত ১০-১৫ দিনের মধ্যে এর তালা খোলা হয়নি। দোতলার সেই কক্ষে ঢুকে আসাদ বেশ কয়েক খাতা খুলে হিসাব দেখাতে থাকে। এ সময় আসাদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এলপি গ্যাস সাপ্লাইয়ের ব্যবসার কথা বলে সুজন তার কাছ থেকে টাকা নেয়। শর্ত থাকে সেই ব্যবসায় পুরো মূলধন আসাদের এর বিনিময়ে এলপি গ্যাসের প্রতি বোতলে লাভের ৮০ টাকা থেকে ৬০ টাকা আসাদকে এবং বাকি ২০ টাকা সুজন নিবে। তার এ কথায় লাভের ৮০ টাকা থেকে ৬০ টাকা মূলধন বিনিয়োগকারীকে দেওয়া হয় এমন নজির আছে কিনা তার দিকেএমন প্রশ্ন ছুড়ে দিলে। জবাবে বলেন, আমাদের মধ্যে চুক্তি যা হয়েছিল আমাকে তো সেটাই দিবে এর বাইরে আমি কিছু জানি না।
হিসাব দেখাতে খাতা খুলে সুজনের সাথে এলপি গ্যাসের ব্যবসার লেনদেনের যে তারিখ দেখিয়েছে তাতে ২০২০ সালের বিভিন্ন সময় লেখা ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ওই সময় সুজন কোন ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল না। বরং সে একটি মাল্টিন্যাশনাল এনজিও’র কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীসহ ও এলাকার নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন লোকজন প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করে অবিলম্বে সুদখোর এই আসাদের প্রতারণার হাত থেকে অসহায় ব্যবসায়ীদেরকে বাঁচাতে তাকে আইনের আওতায় আনতে এবং তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।