আজ ৪ঠা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সমাজের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষক আমিনুল

খাসখবর প্রতিবেদক

মনের অদম্য ইচ্ছা শক্তি আর স্বর্নিভরশীল হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় এ দু’য়ের সমন্বয়ে যেন বাধাই যেন পথচলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনা, যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষক আমিনুল ইসলাম। হাতে ও পায়ে সমস্যা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করা আমিনুল ইসলাম তার অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠেন। তিনি শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতাকে কোন প্রকার বাধা মনে না করে শুধু মাত্র পায়ে লিখে এইচএসসি পাশ করেন। পরে তিনি পায়ে লিখেই শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা চার জন। মানুষকে হাত না পেতে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও কাজ করে সংসার ধর্ম চালানো যায় সমাজে তারই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই শিক্ষক।

কর্মপ্রেমিক আমিনুল ইসলাম জানান, ১৯৮২ সালে মনোহরদী উপজেলার খিদিরপুর ইউনিয়নের দরিদ্র কৃষক মফিজ উদ্দিন আফ্রাদ ওরফে কডু মুন্সির ঘরে আমিনুলের জন্ম। মফিজ উদ্দিনের দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। জন্মের সময় থেকেই আমিনুলের হাতে ও পায়ে সমস্যা ছিল। জন্মের তিন মাসের মাথায় আমিনুল কে নিয়ে তার পিতা মাতা ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ডাক্তারের পরামর্শ নেন। কিন্তু পিতার অর্থিক অনাটনের কারণে তার আর চিকি’সা করা হয়নি। যার করণে জন্মের সময় থেকেই আমিনুল অসুস্থ্য। জন্মের পর থেকেই নিজের পায়ে চলতে না পারা আমিনুল ইসলাম তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে কোন বাঁধা মনে না করে তিনি ভর্তি হন মনতলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। লেখা পড়ায় আনেক মনযোগ থাকার কারণে ২০০০ সালে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন পায়ে লিখে। বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও মাত্র দুই নম্বরের জন্য তিনি প্রাথমিক বৃত্তি পাননি। এতে তিনি হতাশ না হয়ে বরং লেখাপড়ায় তিনি আরও বেশী মনযোগী হন। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার কারণে ধারাবাহিক ভাবে লেখা পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি আমিনুলের পক্ষে। যার কারণে কয়েক বছর পিছনে পরে যায় আমিনুল। তবে মনের অদম্য ইচ্ছা শক্তিতে ২০০৯ সালে খিদিরপুর বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয় হতে বানিজ্যিক বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। কিন্তু শুধু মাত্র পায়ে লেখার জন্য নির্ধারিত সময়ে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় কাঙ্খিত ফলাফল পায়নি। তিনি ওই বছর এসএসসিতে ২.৪১ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি আকবর আলী খান কারিগরি কলেজে ভর্তি হন। ওই কলেজ থেকে আমিনুল ২০১১ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বানিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.০০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। লেখা পড়া চালিয়ে যাওয়ার আদম্য ইচ্ছা শক্তি থাকায় তিনি পরবর্তীতে শিবপুর সরকারি শহীদ আসাদ কলেজে বিএ তে ভর্তি হন। কিন্তু শরীরিক অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেনি তিনি। যার ফলে এইচএসসি পর্যন্তই শেষ হয় আমিনুলের লেখাপড়ার দৌড়। নিজের দুই পায়ে দাড়াতে না পারা আমিনুল চলাফেরা করেন হাঁটুতে ভর দিয়ে।

আমিনুল জানান, দুই ছেলে, স্ত্রীসহ চার সদস্যে পরিবার আমিনুলের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী আমিনুল পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে পছন্দ করেন বিধায় যোগদান করেন বাড়ির পাশে খিদিরপুর আফজালুল উলুম কওমী মাদ্রসায়। সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে তিনি বাংলা, গণিত এবং ইংরেজি পড়ান অত্যন্ত যত সহকারে। কোন প্রকার ফাঁকি দেওয়া ছাড়া তিনি সময়ের যথাযথ ব্যবহার করেন মাদ্রাসায় পাঠদান কারেন।

সরেজমিন মাদ্রাসায় গিয়ে উনার ক্লাশ পরিদর্শন করে দেখা যায় হাতে লিখতে না পারা আমিনুল পায়ের দুই আঙ্গুলের ফাঁকায় চক রেখে বোর্ডে লিখে ছাত্রদের পাঠদান করছেন তিনি।

পাঠদান সম্পর্কে জানতে চাইলে অত্র মাদ্রাসার নাজেরা ক্লাশের ছাত্র আনাস জানান, আমিনুল স্যার অত্যন্ত যত্ন সহকারে পড়ান।

মুখভর্তি দাড়ি, মাথায় টুপি পরা আমিনুল হাঁটুর উপরে একটি টাউজার পরেন। হাঁটুর উপরে কাপড় পরা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চলা ফেরার এবং পায়খানা, পশ্রাবের সুবিধার জন্য উনাকে এই পর্যন্ত টাউজার পরতে হয়।

আমিনুল আরও জানান, চলার জন্য তিনি হুইল চেয়ার ব্যবহার করতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়।

চাকুরি প্রসঙ্গে আমিনুল বলেন, এইচএসসি পাশ করার পর তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিয়েছেন কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবহেলার পাত্র হয়েছেন তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে।
জানা যায়, কেবল ভিটা মাটি ছাড়া আমিনুলের চাষ করার মত তেমন কোন জমি নেই। আর জমি চাষ করার মত শারীরিক সক্ষমতাও নেই তার। যার ফলে স্বল্প বেতনের এই শিক্ষকতা ও প্রতিবন্ধি হিসেবে প্রাপ্ত কার্ডের ভাতার টাকা দিয়েই চলে তার সংসার। তবে এই অল্প উপার্জনেও তিনি সন্তুষ্ট। তার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানান। শিক্ষকতার পাশাপাশি ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাও পোষণ করেন আমিনুল। তবে তার জন্য মূলধনের । সেই অর্থ তার নেই। ফলে অধরাই থেকে গেল তার সেই ইচ্ছা।

আমিনুলের শিক্ষকতা নিয়ে মাদ্রাসার প্রধান আব্দুল বাতেন কুদুরী জানান, আমিনুলের পাঠদানের উপর তিনি সন্তুষ্ট। ইংরেজিতে আমিনুল বেশ পারদর্শী।

     এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ