আজ ৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শেষ সময়ে তুলি আচঁড়ে শিল্পি সত্ত্বাকে ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত প্রতিমা কারিগররা

মো: শাহাদাৎ হোসেন রাজু

চরম বিশৃঙ্খলা ও মহামারির ঈঙ্গিত দিয়ে বছর ঘুরে হিমালয়ের কৈলাশে স্বামী শিবের বাড়ী থেকেই উমা দেবী (দেবী দূর্গা) সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে আসছেন তার বাপের বাড়ি। সাথে আসছেন তার চার সন্তান গণেশ, কার্ত্তিক, লক্ষী আর সরস্বতী। প্রতিবছর শরৎকালে দেবী দূর্গা তার চার সন্তানকে সাথে নিয়ে সমতল ভূমির এই বাংলায় বাপের বাড়ী বেড়াতে আসেন। আর মাত্র কয়েকদিন বাকী। দেবী দূর্গার আগমনকে ঘিরে স্বনাতন ধর্মালম্বীরা ব্যতি-ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

নরসিংদী জেলার বিভিন্ন মন্ডপ সাঝ-সজ্জ্বা চলছে, সে সাথে প্রতিমালয়গুলোতে দেবী মূর্তি নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ, তুলি আচঁড়ে শিল্পি সত্ত্বাকে ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে মৃৎশিল্পিরা। মূর্তি তৈরির কাজ শেষ এখন গায়ে রঙ ছোঁয়ানোর অপেক্ষায় মৃৎশিল্পিরা।

পুঞ্জিকা মতে আগামীকাল বুধবার ( ৬ অক্টোবর) শারদীয় দুর্গোৎসবের পূণ্যলগ্ন, শুভ মহালয়া পিতৃপক্ষের শেষে দেবীপক্ষের শুরু। চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আবাহনই মহালয়া। বাঙ্গালি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এ হচ্ছে দুর্গা দেবীর আগমনী বার্তা। আগামী ১৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে ৫ দিনের এ ধর্মীয় উৎসব শেষ হবে। এবার দেবীদুর্গা আসছেন ‘ঘটক’ ঘোড়ায় চড়ে আর ফিরে যাবেন দোলায় (পালকি) চড়ে। এ বছর দেবী দূর্গা মুত্তলোকের বাসিন্দাদের সুবার্তা বয়ে আনছে না বরং দেবীর আগমন চরম বিশৃঙ্খলা এবং ক্ষয়ক্ষতি দেখা দেওয়ার ঈঙ্গিত বহন করছে৷।আর দোলায় ফিরে যাওয়ার ফল ‘মড়ক’। দেবী দুর্গা যদি দোলায় চড়ে গমনাগমন করেন তার ফল মর্ত্যে বহু মৄত্যু অর্থাৎ মহামারির ঈঙ্গিত দিচ্ছে ৷

আগামী ১০ অক্টোবর মহাপঞ্চমীর মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও মূলত মহালয়া থেকেই পূজারীরা দুর্গা মায়ের আগমন ধ্বনি শুনতে পান। শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘিরে নানা আয়োজনে ব্যস্ত নরসিংদীর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে উৎসবের আমেজ অন্যান্য বছরের মত তেমন একটা নেই বললেই চলে। করোনা পরিস্থিতির কারণে মন্ডপগুলো এবছর কোন সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা থাকবেনা। ভক্তবৃন্দ ও দর্শনার্থীদের মাক্স পড়ে এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। নরসিংদীর মন্দিরে মন্দিরে চলছে প্রতিমা সাজসজ্জার কাজ। প্রতিমালয়গুলোতে দেবী মূর্তি নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ, তুলি আচঁড়ে শিল্পি সত্ত্বাকে ফুটিয়ে তুলে গায়ে রঙ ছোঁয়ানোর অপেক্ষায় মৃৎশিল্পিরা। আয়োজকরা ছুটছেন দর্জিপাড়ায়। মা দুর্গার লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ির জরির কাজ, গণেশের ধুতিতে নকশাদার পাড় বসানো আর মহিষাসুরের জমকালো পোশাক তৈরির কাজ। কেউবা ছুটছেন কামারপাড়ায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে বানিয়ে নিচ্ছেন দেবীর হাতের চক্র, গদা,

তীর-ধনুক ও খড়গ-ত্রিশূল আর ভীষণ ঘষামাজায় মিস্ত্রিরা ব্যস্ত মন্ডপগুলোকে নতুন রূপে সাজিয়ে তুলতে। ডেকোরেটর কর্মীদেরও ব্যস্ততার শেষ নেই। আয়োজকদের ফরমায়েশ আর ডিজাইন অনুযায়ী গড়ে তুলছেন দৃষ্টিনন্দন অস্থায়ী পূজামন্ডপ। চলছে সংস্কারের শেষ কাজটুকু।

এবার নরসিংদী জেলায় মোট ৩৫৫ টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। নরসিংদীর মন্ডপগুলোতে চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ হলেও রং-তুলির কাজ ও সাজসজ্জার কাজ অনেকটাই বাকী। শেষ মূহুর্তে এসে রং-তুলির আচরে নিজেদের ফুটিয়ে তুলছেন মৃৎশিল্পিরা।

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব সুব্রত চন্দ্র দাস জানান, এবছর নরসিংদী জেলায় ৩৫৫ টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এরমধ্যে নরসিংদী পৌরসভায় ৩০টি ও মাধবদী পৌরসভায় ১৫টি সহ নরসিংদী সদর উপজেলায় ৯৮টি, পলাশ উপজেলায় ৪৬টি, শিবপুর উপজেলায় ৭০টি, মনোহরদী উপজেলায় ৫১টি, বেলাব উপজেলায় ২৩টি এবং রায়পুরা উপজেলায় ৬৭টি মন্ডপে দেবী দুর্গার আরধনা করবে পূজারীরা।

নরসিংদীর তুর্য্য প্রতিমা শিল্পালয়ের স্বত্বাধিকারী দুলাল পাল জানান, ‘প্রতিমা তৈরিতে মূলত মাটি, বাঁশ-খড়, দড়ি, লোহা, ধানের কুঁড়া, পাট, কাঠ, রঙ, বিভিন্ন রঙের শিট ও শাড়ি-কাপড়ের প্রয়োজন হয়। প্রতিমা গড়া শেষ হলে রংতুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয় অবয়ব। প্রতিমা তৈরি করা অনেক কষ্টের। বছরের অন্যান্য সময় তেমন কাজ না থাকলেও এই সময় ব্যস্ততা বেড়ে যায়। তবে সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও সে অনুযায়ী প্রতিমা তৈরির মজুরি বাড়েনি। তিনি বলেন, এবছর তার কারখানায় ৬ জন কারিগর নিয়ে সর্বাধিক ২১ টি প্রতিমা তৈয়ার করেন।

নরসিংদীর মৃম্ময়ী প্রতিমালয়ের স্বত্বাধিকারী প্রতিমাশিল্পী সম্ভুনাথ পাল জানান, ‘পূজা শুরুর আগেই প্রতিমা তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে মৃৎশিল্পীরা বিরামহীনভাবে কাজ করছেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে তাদের কর্মযজ্ঞ। চাহিদামত প্রতিমাকে গড়ে তুলতে চেষ্টার কোনও কমতি নেই।’ তিনি বলেন, ‘ এবছর করোনা পরিস্থিতির কারণে পূজা হবে কি হবেনা সেই আশঙ্কায় আমার কারখানায় ৫ জন কারিগর নিয়ে মোট ৮ প্রতিমা তৈরি করেছি।

বিশ্বকর্মা প্রতিমা শিল্পালয়ের সঞ্জিত পাল বলেন, প্রতিমা তৈরিতে প্রচুর কাঁচাপণ্যের প্রয়োজন হয়। তবে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় এবার প্রতিমা তৈরিতে খরচ কিছুটা বেড়েছে। প্রতিমা তৈরি শেষ হলে এরপর শুরু হবে যাবে সাজসজ্জার কাজ।’ বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে অজন্তা, অরিয়েন্টেল, দেবী ও স্বাম্য নামে চার প্রকারের প্রতিমা তৈরি করেন মৃৎশিল্পীরা। আয়োজকদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে অজন্তা প্রতিমা।

নরসিংদী জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের আহবায়ক অনিল চন্দ্র ঘোষ জানান, ‘সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে শারদীয় দুর্গাপূজা। প্রতি বছরের মতো এবারও এ উৎসবটি অতটা জাকজমকভাবে উদযাপন করা যাবে না। করোনার কারণে এবারের আয়োজনে বেশকিছু ভিন্নতা আছে। তবে গত বছরের চেয়ে এবার পূজামন্ডপের সংখ্যা বেশী। সরকারী বেশ কয়েকটি নির্দেশনা মেনে আমাদেরকে পূজা উদযাপন করতে হবে। আমরা নির্দেশনা অনুযায়ী ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। এখন প্রতিমা তৈরি এবং প্যন্ডেল নির্মাণের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সাথে আলাদা আলাদা বৈঠক হয়েছে। পূজা নির্বিঘে করতে প্রশাসন থেকে আমরা সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছি।’

আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান।

     এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ