খাসখবর প্রতিবেদক
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার মো. মিজহারুল ইসলাম’র বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে তাকে প্রত্যাহারের দাবিতে দলিল লেখকরা নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। ফলে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে দলিল লেখকরা বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
এদিকে এ অচলাবস্থার ফলে কর্মব্যস্ত শিবপুর সাব রেজিস্ট্রার অফিস যেন নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। আর দীর্ঘদিন যাবৎ সাব রেজিস্টার ও দলিল লেখকদের দ্বন্দ্বে অচলাবস্থায় দলিল নিবন্ধন করতে আসা দাতা ও গ্রহীতারা শিকার হচ্ছেন চরম ভোগান্তির। সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব।
সরেজমিনে শিবপুর উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার অফিস ঘুরে দেখা যায়, দলিল লেখকদের প্রায় সবগুলো সেরেস্তাই ফাকা এবং তালা বদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। হাতে গোনা কয়েকজন দলিল লেখকের দেখা মিললেও নেই কোন কর্মব্যস্ততা। অফিসের ভিতর দলিল মোহরারসহ অন্যান্য কর্মকারীদের উপস্থিতি দেখা গেলেও তাদেরকে অলস সময় পার করতে দেখা যায়। এসময় দলিল লেখক ও কর্মচারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাব রেজিস্টার মিজাহারুল ইসলাম কিছুদিন যাবৎ ছুটিতে রয়েছেন। দলিল লেখকরা জানান তার দুর্নীতি অনিয়ম ও অতিরিক্ত ঘুষ গ্রহণের বিষয়ে আইন বিষয়ক সচিব, আইন মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসক নরসিংদী, জেলা রেজিস্ট্রার, স্থানীয় সংসদ সদস্য, শিবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান বরাবর তারা লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে নরসিংদী জেলা রেজিস্ট্রার বিষয়টি মিমাংসার জন্য শিবপুর উপজেলা সাব রেজিস্টার অফিসে গেলে দলিল লেখকরা উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার মো. মিজহারুল ইসলাম গত ৫ ডিসেম্বর ২০২১ সাব রেজিস্ট্রার অফিসের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন বলে জানান। বিভিন্ন সময়ে দলিল লেখকরা এর প্রতিবাদ করলেও কোনো লাভ হয়নি। সাব-রেজিস্ট্রার উল্টো তাদের হুমকি-ধামকি দিয়ে অনিয়মের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেন। ফলে তারা বাধ্য হয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে তার চাহিদা পূরণ করে দলিল করতে বাধ্য হচ্ছেন। তার দুর্নীতি ও অনিয়মের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাই এ সাব রেজিস্ট্রারের অধীনে তারা কোন দলিল নিবন্ধন করবেনা বলে জেলা সাব রেজিস্ট্রারকে তা জানিয়ে দেন। তারা উক্ত সাব রেজিস্ট্রারের দুর্নীতি ও অনিয়মের সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সহ তাকে দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানান বলে এ প্রতিবেদককে জানান।
দলিল লেখক সমিতির আহবায়ক মো. কামাল হোসেন শেখ জানান, দলিল রেজিস্ট্রি করতে গেলে দলিল প্রতি এক হাজার টাকা দাবি করেন সাব রেজিস্ট্রার মিজহারুল ইসলাম। এমনকি সাধারণ একটা অক্ষর ভুল থাকলেও তার জন্য অতিরিক্ত টাকা দাবি করেন তিনি। তার চাহিদা মাফিক অর্থ প্রদান না করলে তিনি দলিল নিবন্ধন থেকে বিরত থাকেন। সরকারি ফি ছাড়া বন্ধকী দলিলে অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিলে অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা, ওয়াসিয়তনামা দলিলে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, বিলা এওয়াজ দলিলে ৫০ হাজার টাকা এবং সাবকবলা দলিলে প্রতি তাকে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়।
তিনি আরো বলেন,’ আমি দীর্ঘ ৪৫ বছর যাবত এ পেশায় নিয়োজিত আছি। প্রত্যেক সাব রেজিস্ট্রারের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক ছিল বর্তমানের সাব রেজিস্ট্রারের মতো এরকম পরিস্থিতি কখনো হয়নি। আমরা সাত মাস যাবৎ চেষ্টা করছি তার মধ্যে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে কিন্তু তিনি দিনকে দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন। দলিল প্রতি তার চাহিদার জোগান দিতে
দাতা গ্রহিতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ায় তাদের কাছে বদনামের ভাগি আমরা হচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রে তারা আমাদের দোষারোপ ও তিরস্কার করেন। আমরা সাব-রেজিস্ট্রারকে আমাদের সাথে আলোচনায় বসার কথা বললে তিনি পরপর কয়েকবার দিনক্ষণ নির্ধারণ করেও বসেনি। পরে দলিল লেখকের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আমরা বিভিন্ন দপ্তরে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করি। ‘
মো. কামাল হোসেন শেখ বলেন, ‘আমরা কোন দলিল দাখিল করার সাথে সাথে সাব রেজিস্ট্রার তার অফিস সহায়কের মাধ্যমে একটি স্লিপে টাকার অংক লিখে দেয় এবং এ টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত তিনি দলিল নিবন্ধন করে না।’ তিনি একটি উদাহরণ টেনে
বলেন একটি মৌজায় তিনটি খতিয়ান থাকে আমরা খতিয়ানগুলি একত্রিত করে ১টা বা ২টা দাগ থেকে দখল দেখিয়ে বিগত দিনে দলিল নিবন্ধন করে আসলেও বর্তমান সাব রেজিস্ট্রার তা করবে না। খতিয়ান অনুযায়ী দলিল নিবন্ধন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকা দিলে তা তাৎক্ষণিক করে দেন। এছাড়া তিনি দুপুর ১২টায় অফিসে আসলেও বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে আটকে রেখে টাকা আদায় করার পর দলিল রেজিস্ট্রি করে দেয়। এ ঘটনায় বাধা দিলে লাইসেন্স বাতিল করার হুমকি ধামকি দেন সাব রেজিস্ট্রার মিরহাজুল।
তিনি বলেন, ‘গত দুইদিন নরসিংদী জেলা রেজিস্ট্রার আমাদের অফিসে এসে আমাদের সাথে মতবিনিময় করেন এবং প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ভাবে ডেকে নিয়ে তাদের কথা শুনেন। তিনি বিষয়টি সুরাহা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন।’
আমাদের সর্বশেষ কথা এলাকার জনগণের স্বার্থে আমরা সকল দলিল লেখক সাব রেজিস্টার মিজহারুল ইসলামের অধীনে কোন দলিল নিবন্ধন করবো না। তিনি আরো জানান, দীর্ঘদিন যাবত এ অবস্থা চলতে থাকলে অবস্থার অবনতি দেখে সাব রেজিস্ট্রার ছুটির অজুহাতে অফিসে আসা থেকে বিরত আছেন।
দলিল লেখক সমিতির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. খলিলুর রহমান জানান, আগের সাব রেজিস্ট্রার নেওয়াজ মিয়ার সাথে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে দলিল নিবন্ধন করতে পারতাম। তিনি অন্যত্র বদলি হলে আমরা আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদাই জানাই। সেই অনুষ্ঠানে জেলা রেজিস্ট্রারও উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, ” বর্তমান সাব রেজিস্টার মিজহারুল ইসলাম ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগর থাকাকালীন সময়েও দলিল নিবন্ধন নিয়ে বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িত ছিলেন বলে সেখানকার দলিল লেখকরা আমাদের জানিয়েছেন।
তিনি শিবপুরে যোগদানের পর প্রতি দলিলে অতিরিক্ত এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি জানালে আমরা তা মেনে নেই এবং বিগত ৭ মাস যাবৎ এভাবেই দিয়ে এসেছি। তিনি স্বেচ্ছায় আমাদের বলেন প্রতি দলিল থেকে আমাদের সমিতির নামে ২০০ টাকা তিনি জমা রাখবেন। সে হিসেবে গত রমজানে সমিতি তার কাছে পাওনা হয় ৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। তিনি সমিতিতে ৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা জমা করলেও বাকী ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন।
তাই আমরা দলিল লেখকরা সিদ্ধান্ত নেই এই দূর্নীতিবাজ অর্থলোভী সাব রেজিস্ট্রারের অধীনে আমরা কোন দলিল লিখব না। প্রয়োজন হলে আমরা কলম বিরতিতে যাব।
সাম্প্রতিক সময়ে শিবপুর একটি বন্ধকি দলিল নিবন্ধন করতে সাব রেজিস্ট্রার মিজহারুল ইসলামকে অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন পাভেল নামে এমন এক ব্যক্তির সাথে মোবাইল ফোনে কথা বললে তিনি জানান, ওই দলিল নিবন্ধন করতে মিজহারুল ইসলাম তার কাছে অতিরিক্ত ৩০ হাজার টাকা দাবী করেন। অনেক কষ্টে-পিষ্ঠে তা তিনি ২৫ হাজার টাকায় করিয়ে নেন।
এদিকে সাব রেজিস্ট্রার মিজহারুল ইসলামকে না পেয়ে তার মোবাইল নাম্বারে বেশ কয়েকবার ফোন করলে তিনি তা রিসিভ করেনি।
এ ব্যাপারে জেলা রেজিস্ট্রার আবুল কালাম মঞ্জুরুল ইসলামের সাথে কথা বলতে তার কার্যালয়ে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, উপর মহলের নির্দেশে এ বিষয়ে তদন্ত করছি। আমি এ পর্যন্ত ৩ দিন শিবপুর অফিসে গিয়েছি এবং দলিল লেখকদের সাথে কথা বলেছি।
এভাবে চলতে থাকলে দলিল ঝটে পড়বে শিবপুর সাব রেজিস্ট্রার অফিস এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, না তেমনটা হবে না। এই অবস্থার কথা ভেবে শিবপুরে সপ্তাহে দুইদিন বদলী সাব রেজিস্ট্রার দেওয়া হচ্ছে।