খাসখবর প্রতিবেদক
রায়পুরায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক জনপদের নাম নিলক্ষা। এই জনপদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। এ অর্থের জোড়ে কাউকে পরোয়া না করে প্রায়ই প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে মরণনেশায় লিপ্ত হচ্ছেন ওই এলাকার মানুষ। এ টেঁটাযুদ্ধে জয়ী হতে আশপাশ চরাঞ্চলের গ্রামগুলো থেকে ভাড়ায় লাঠিয়াল এনে বিভিন্ন মারণাস্ত্র নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে জড়াচ্ছেন তারা । এ নিলক্ষা চরাঞ্চল হলেও সম্প্রতিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে অনেকটাই এগিয়েছে এই জনপদ। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই টেঁটা নিয়ে মরণযুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে এখানকার মানুষগুলো।
যুগযুগ ধরে চলে আসা এই টেঁটাযুদ্ধ যেন এলাকাবাসীর অভিশাপ্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এ টেঁটাযুদ্ধ নিয়ে স্থানীয় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করলেও সংঘাতের সমাধানের উপায় জানা নেই এ নিলক্ষাবাসীর। তাদের একটি কথা `জন্মের পর থেকেই এ টেঁটাযুদ্ধ দেখে আসছি, আর টেঁটাযুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক লোক নিহত হয়েছে’। কিন্তু মরণ নেশা এ টেঁটাযুদ্ধ যুগের পর যুগ চলতে থাকলেও তার মূল নায়করা থাকছে ধরাছোয়ার বাহিরে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মাত্র কিছু সংখ্যক দাঙ্গাবাজদের কারণে যুগযুগ ধরে অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে নিলক্ষা ইউনিয়নের ৭টি গ্রামজুড়ে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে সমাজপতির মুখোশধারী একটি শ্রেণী। বিবfদমান দলের মধ্যে সমঝোতার নামে তারা চালান অর্থ বাণিজ্য। যার ফলে অল্প সময়ের মাঝে টেঁটাবাজরা হয়ে উঠেন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। বর্তমানে নিলক্ষার টেঁটাযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন ওই এলাকার এক সময়ের দিন মুজুর সুমেদ আলী। যিনি এখন নিলক্ষার কোটিপতি লাঠিয়াল সর্দার হিসেবে পরিচিতি। তার বিরুদ্ধে রায়পুরা থানায় হত্যাসহ ১০টি মামলা রয়েছে। তার মধ্যে পুলিশের প্রকাশিতব্য জিআর ওয়ারেন্ট তালিকায় তার নাম রয়েছে রায়পুরা থানার মামলা নং ১৫(১২)১৬, ৩(৬)১৬, ৪০(১১)১৮, ৫৯(৮)১৭, ২(৬)১৬ ও বি: ট্রা-১০৬/১৭ এ মামলা গুলোতে। কিন্তু প্রকাশ্যে নরসিংদী শহরের এ সুমেদ আলী ঘুরে বেড়ালেও রহস্যজনক কারণে থাকছেন পুলিশের ধরাছোয়ার বাহিরে। কে এই সুমেদ আলী : নিলক্ষা ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের মৃত মন্নর আলীর ছেলে সুমেদ আলী। নেই তার কোন অক্ষরজ্ঞান। আজ থেকে ১৭-১৮ বছর আগে তিনি ছিলেন হরিপুর গ্রামের এক ব্যক্তির বাড়ির দিনমুজুর। এ দিনমজুর থেকে গোপীনাথপুর গ্রামের কিছু জেলে পরিবারের সঙ্গে শুরু করেন মেঘনা নদী থেকে মাছ ধরার কাজ। মাছ শিকারি থেকে হয়ে যান টেঁটা দিয়ে মানুষ শিকারি। এরপর থেকে লাঠিয়াল হিসেবে বিভিন্ন স্থানে ভাড়া যাওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় তার টেঁটাযুদ্ধের মরণনেশায় প্রদচারনা। ওখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ ও টেঁটা শিকারি হিসেবে মানুষের বাড়ির লুণ্ঠিত অর্থের স্বাদ পেয়ে দিনমজুর থেকে পরিচিতি লাভ করেন নিলক্ষার লাঠিয়াল সর্দার হিসেবে। যারা তার কথা মতে টেঁটাযুদ্ধে অংশ নিতে রাজি না হয় তাদের দিতে হচ্ছে মোটা অংকের চাঁদা। এ টাকায় এক সময়ের দিনমজুর এখন হয়ে উঠছেন কোটিপতি। বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে তার লাখ লাখ টাকা। নরসিংদী শহরের বাসাইল মহল্লায় রয়েছে তার বিশাল বাড়ী এবং নামে বে-নামে শহেরর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে আরও জায়গা। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে শুধু রায়পুরা থানাই রয়েছে হত্যাসহ ১০টি মামলা। এ সুমেদ আলী এমন কোন কাজ নেই, সে যে করে নাই। নিলক্ষার টেঁটা সন্ত্রাসের গড ফাদার ও এলাকাবাসীর জন্য মূর্তিমান আতষ্ক সে। টেঁটাযুদ্ধ, হত্যা, চাঁদাবাজি ও দালাল বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রেই মূল হোতা এ সুমেদ আলী। শুধু তাই নয় টেঁটাযুদ্ধ নিয়ন্ত্রনে আনতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এলাকায় পৌঁছালে তাদের উপর হামলা চালায় তার নির্দেশে তারই ভাড়াটে সন্ত্রাসী বাহিনীরা। তাদের হামলায় তৎকালীন রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজহারুল ইসলামসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়। এ ব্যাপারে পুলিশ বাদী হয়ে সুমেদ আলীকে প্রধান আসামী করে রায়পুরা থানায় সরকারী কাজে বাধা ও বিস্ফোরণ দ্রব্য আইনে মামলাও দায়ের করেন। বর্তমানে এ মামলা আদালতে বিচারাধিন।
যে ভাবে শুরু হয় সুমেদ আলীর উত্থান: ২০১২ সালে ২১ অক্টোবর। নিলক্ষার গোপীনাথপুর গ্রামের জজ মিয়া ও রহিম মিয়া নামে তাদের দুই চাচা-ভাতিজার মধ্যে জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে সালিশ বৈঠক বসে। এ সময় জজ মিয়ার সমর্থক আব্দুল হেকিমকে প্রতিপক্ষরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে। এ সময় সুমেদ আলী রহিমের পক্ষ নিয়ে এ সংঘর্ষ ছড়িয়ে দেন পার্শ্ববর্তী হরিপুর, দড়িগাঁও, সোনকান্দি, বীরগাঁও ও আমিরাবাদসহ নিলক্ষার ৭টি গ্রামে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে তৎকালীন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী রাজি উদ্দিনের নির্দেশনায় স্থানীয় প্রশাসন দু’পক্ষের মধ্যে আপোস-মীমাংসা করে দিয়ে ছিলেন। দীর্ঘ চার মাস বিরতির থাকার পর তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উল্লিখিত গ্রুপদ্বয় পুনরায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আপস-মীমাংসার পর এ পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েক দফা সংঘর্ষে দু’পক্ষেরই হত্যা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশের উপর হামলাসহ এ সব ঘটনায় মামলা পাল্টা মামলা হয় ১৭টি। ওই মামলায় মধ্যে ১০টিতেই আসামি করা হয় লাঠিয়াল সর্দার সুমেদ আলীকে। গত ২ জুন নরসিংদীর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)’র হাতে গ্রেফতার হন সুমেদ আলীর এক অনুসারি রাজিব। এখনও ধরাছোয়ার বাহির রয়েছে সুমেদ আলী।
স্থানীয় এলাকাবাসীর দাবি এ সুমেদ আলী গ্রেফতার হলেই অশান্ত নিলক্ষা হয়ে উঠবে শান্ত সুনিবীর একটি জনপদ। ভূলে যাবে মরণ নেশারমতো অভিশাপ্ত এ টেঁটাযুদ্ধ।
রায়পুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) গোবিন্দ সরকারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ওয়ারেন্টের আসামী গ্রেফতারের ব্যাপারে অভিযান চলমান রয়েছে।