আজ ২৬শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

প্রচণ্ড তাপদাহে বোরো ধান কাটায় ব্যস্ত নরসিংদীর চাষীরা

মো. শাহাদাৎ হোসেন রাজু

দেশজুড়ে চলা প্রচণ্ড তাপদাহে কৃষি নির্ভর জেলা নরসিংদীর মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। বিশেষ করে এ সময় চরম বিপাকে পড়েছেন এ জেলার বোরো ধান চাষিরা।
প্রচণ্ড গরমের কারণে ভোর থেকে ধান কাটা শুরু করছে কেউ কেউ। কিন্তু বেলা ১০টা থেকে ১১টার পর গরমে আর মাঠে কাজ করতে পারছে না কৃষকেরা। কিছু সময় কাজ করলে হাঁপিয়ে উঠছে। ঘামে কাপড় ভিজে একাকার। কাজের মাঝে বারবার বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। এতে কাজের গতি কমে যাচ্ছে। গরমের কারণে শ্রমিকেরও সংকট দেখা দিয়েছে। শ্রমিক পাওয়া গেলেও দিতে হচ্ছে চড়া মূল্য। তবে যেকোনো সময় বৃষ্টি শুরু হলে জমি থেকে এই পাকা ধান বাড়িতে নিতে বিড়ম্বনা এবং ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। তাই তীব্র গরমেও অধিক কষ্ট করে ধান কাটছে কৃষকেরা।
তীব্র তাপদাহ ও হিট এলার্ট এবং তীব্র গরম উপেক্ষা করে পাকা বোরো ধান কেটে ঘরে তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন নরসিংদীর কৃষকরা। জেলায় গত বছরের তুলনায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে এবার। ফলে তীব্র গরম ও রৌদ্রের প্রকৃতি উপেক্ষা করে দ্বিগুণ মজুরি দিয়ে কৃষকরা তাদের পাকা ধান কাটছেন।
এদিকে দেশজুড়ে তীব্র দাবদাহ থেকে বাঁচতে বৃষ্টির প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে বৃষ্টি নয় রোদ চান নরসিংদীর বোরো চাষিরা। ফলন ভালো হওয়ায় ধান ঘরে তুলতে এমন খরতাপ কষ্টের বদলে আনন্দ দিচ্ছে তাদের। জেলায় কয়েক জায়গায় কালবৈশাখি ঝড় আর শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হওয়ায়, দ্রুত ধান কেটে ঘরে তোলার ধুম পড়েছে জেলার ছোট বড় বিস্তৃর্ণ মাঠগুলোতে।
নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে বোরো মৌসুমে জেলায় হেক্টর প্রতি হাইব্রিড ও উফশী ৫.১১ মেট্রিক টন ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে জেলায়। কৃষকের বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে কৃষক প্রতি উফশীতে ৫ কেজি বীজ ও সার এবং হাইব্রিডে ২ কেজি বীজ বিতরণ করা হয়। চাষের শুরু থেকেই আবহাওয়া সম্পূর্ণ অনুকূলে থাকায় জেলা বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে চলতি মৌসুমে বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচে ২২ থেকে ২৪ মণ ধান পাবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কৃষকরা। এবছর উৎপাদনের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৮০৫ মেট্রিক টন।
চলতি বোরো মৌসুমে নরসিংদী জেলায় ৫৬ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে উফশী জাতের ধান ৫১ হাজার ৪৬৩ হেক্টর, হাইব্রিড ৫ হাজার ও স্থানীয় জাত ৫০ হেক্টর চাষাবাদ করা হবে বলে মনে করছে জেলা কৃষি বিভাগ। চাষাবাদ অনুযায়ী নরসিংদীর সদর উপজেলায় ৮ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হবে ৪৩ হাজার ৫৪৩ মেট্রিকটন, পলাশ উপজেলায় ৪ হাজার ১৯২ হেক্টর ২১ হাজার ৪২৪ মেট্রিকটন, শিবপুর উপজেলায় ১০ হাজার ১৬৫ হেক্টর ৫১ হাজার ৯৯০ মেট্রিকটন, মনোরদী উপজেলায় ১১ হাজার ৪৮ হেক্টর ৫৬ হাজার ৫০৬ মেট্রিকটন, বেলাব উপজেলায় ৫ হাজার ৭৬৫ হেক্টর জমিতে ২৯ হাজার ৪৮৫ মেট্রিকটন ও রায়পুরা ১৬ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে ৮৬ হাজার ৬২০ মেট্রিকটন।
অপরদিকে তীব্র গরমে শ্রমিক সংকট থাকায় দ্বিগুণ মজুরি দিয়ে কৃষকদের ধান কাটতে হচ্ছে। পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও সমান তালে ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছে। নরসিংদীর মূল শ্রমিকের এক তৃতীয়াংশ এখন ধান কাটায় নিয়োজিত। এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দেড়গুণ অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারিভাবে ধানের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ টাকা কেজি। এখানে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়া ২০-৩০ হেক্টর জমিতে বেশি ধান চাষ করেছে কৃষকরা। উৎপাদিত ধান থেকে চাল উৎপাদন হবে ৯৭ হাজার ২৭৭ মে. টন।
সদর উপজেলার ধামের ভাওলা এলাকার কৃষক আব্দুল লতিফ জানান, প্রায় ১০বিঘা জমিতে এবার বোরো আবাদ করেছেন। গতবারের তুলনায় ফলনও হয়েছে বেশ ভাল। কয়েকদিন আগে থেকে তিনি ধান কাটা শুরু করেছেন। তীব্র গরম থাকায় শ্রমিকদের বেশি মজুরি দিয়ে ধান কাটছেন। গরমে শ্রমিকরা ধান কাটাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে অনেকে। এমন বৈরী আবহাওয়ায় যে কোন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিতে পারে। যে কারণে তিনি আগে ভাগেই ধান কেটে ঘরে তুলছেন বলে জানান।
রায়পুরা উপজেলার নলবাটা গ্রামের কৃষক আমিরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান, জামাল হোসেন জানান, চলতি মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়নি। ফলে এবার কোনো জমি অনাবাদি থাকেনি। সরকার বিনামূল্যে আমাদের সার বীজ দিয়েছে। পুরো বোরো মৌসুম জুড়ে বড় কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায়, আবহাওয়া সম্পূর্ণ চাষের অনুকূলে থাকায় এবং ধানের রোগবালাই কম থাকায় নরসিংদীতে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
মনোহরদী উপজেলার হাফিজপুর গ্রামের আরশাদ আলী নামে এক কৃষক জানান, তিনি ২বিঘা জমিতে ইরি ধান চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে তিনি ধান ঘরে তুলেছেন। ২ বিঘা জমিতে ৬০ মণ ধান পেয়েছেন তিনি। কিন্তু তীব্র গরমে শ্রমিক সংকট দেখা গেছে। নরসিংদীতে ধান কাটা শ্রমিকদের মধ্যেই ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলায় বিদায় প্রচন্ড গরমের অনেক শ্রমিকই ধান কাটার কাজে অনিহা প্রকাশ করে। ফলে শ্রমিক সংকটে দেখা দিয়েছে। শ্রমিক সংকটে বেশি মজুরি দিয়ে ধান কাটতে হয়েছে।
জেলার কিছু জায়গায় হঠাৎ কালবৈশাখি ঝড় ও শিলা বৃষ্টির কারণে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায়, দ্রুত ধান কাটার পরামর্শ দিলেন কৃষি কর্মকর্তারাও।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক, মো. আজিজুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে ধান কাটা শুরু হয়েছে। এখন প্রায় ৬৫ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। নরসিংদীর কোনো উপজেলায় অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি। এই মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগে জলাবদ্ধতা না থাকায় কৃষকরা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বোরো চাষের উপর জোর দিয়েছিল।
নরসিংদী জেলায় এবার ৫৬ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ করা হয়েছে।

     এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ