মো: শাহাদাৎ হোসেন রাজু
করোনা প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের আজ স্থবির, থমকে গেছে অর্থনৈতিক চাকা। বেকার হয়ে পড়েছেন দেশ- বিদেশের কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষ। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের শ্রম বাজারের লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ চাকুরি হারিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে। দেশের বেকার ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা পূরণে বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা সর্বদা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
দেশের একজন নাগরিকও যেন অনাহারে দিন কাটাতে না হয় সেজন্য ব্যবসায়ীদের মাঝে প্রণোদনা, গৃহহীনদের আবাসন ব্যবস্থা, অভাবী, দুঃস্থ ও অসহায়দের মাঝে নগদ অর্থ ও চাউল বিতরণ করে আসছেন। সর্বশেষ পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে এক কোটি’র অধিক পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল বিতরণের ঘোষণা দেয় সরকার।
সুবিদাভোগি বাছায়ের ক্ষেত্রে ১২ টি শর্ত দিয়ে এর মধ্য থেকে যে কোন ৪টি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে অভাবী, দুঃস্থ, অসহায় ও অসচ্ছল পরিবারের সদস্যদের মাঝে ১০ কেজি করে চাউল বিতরণ কর্মসূচী অব্যাহত রেখেছেন। সরকার ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী আজ ১৯ জুলাই বিতরণ কার্যক্রমের শেষ দিন।
নরসিংদী জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ঈদ উপহার (ভিজিএফ) ১০ কেজি করে চাল বিতরণের জন্য জেলার ৬ টি উপজেলার ৬টি পৌরসভা ও ৭১ টি ইউনিয়নে মোট এক লাখ ৩৭ হাজার ৬৫৯ জন সুবিদাভোগির বিপরীতে এক হাজার ৩৭৬ দশমিক ৫৯ মে: টন (১৩ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯০ কেজি) চাল বরাদ্ধ দেয় দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়।
চাল বরাদ্ধ দেওয়ার সাথে সাথে বরাদ্ধপত্রে সুবিদাভোগি বাছাইয়ের শর্ত গুলো দিয়ে দেওয়া হলেও জেলার কোন পৌরসভা বা ইউনিয়নে তা মানা হয়নি। সর্বত্রই উপেক্ষিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া শর্ত ।
১০ কেজি চালের সুবিদাভোগী কারা হবেন সরকারের দেওয়া ১২টি শর্তের মধ্যে চারটি পূরণ হয় এমন ব্যক্তি বা পরিবারকে দুঃস্থ বলে গণ্য করে সহায়তা দিতে বলা হয়েছে। শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- যাদের ভিটাবাড়ি ছাড়া কোন জমি নেই, যে পরিবার দিনমজুরের আয়ের ওপর নির্ভরশীল, যে পরিবারে মহিলা শ্রমিকের আয় বা ভিক্ষাবৃত্তির ওপর নির্ভরশীল, যে পরিবারে উপার্জনক্ষম পূর্ণবয়স্ক কোন পুরুষ সদস্য নেই, যে পরিবারে স্কুলগামী শিশুকে উপার্জনের জন্য কাজ করতে হয়, যে পরিবারে উপার্জনশীল কোন সম্পদ নেই, যে পরিবারের প্রধান স্বামী পরিত্যক্তা, যে পরিবারের প্রধান অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা, যে পরিবারের প্রধান অস্বচ্ছল ও অক্ষম প্রতিবন্ধী, যে পরিবার কোন ক্ষু্দ্রঋণ পায়নি, যে পরিবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে চরম খাদ্য বা অর্থ সংকটে পড়েছে এবং যে পরিবারের সদস্যরা বছরের অধিকাংশ সময় দুই বেলা খাবার পায় না।
ইউনিয়ন/পৌরসভা ভিজিএফ কমিটির প্রকাশ্য সভায় এই তালিকা প্রণীত এবং প্রত্যায়িত হতে হবে। তালিকা এমনভাবে করতে হবে যে, একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি ভিজিএফ কার্ড বরাদ্দ না পায়। বরাদ্দ করা চাল শর্ত মেনে ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে বলে বরাদ্দপত্রে উল্লেখ করা হয়।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে চাল বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির ছড়াছড়ি। জেলার কোন একটি ইউনিয়ন বা পৌরসভায় হালনাগাদ তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। পূর্বের তালিকা অনুযায়ীই চাল বিতরণ করা হয়। আর এই তালিকায় স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ ও পক্ষপাতিত্বে সমাবেশ ঘটিয়ে প্রণয়ন করার অভিযোগ রয়েছে সর্বত্র।
তালিকাভুক্ত যারা রয়েছেন তারা প্রত্যেকেই মেয়র, কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, শহর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আত্মীয়-স্বজন ও পছন্দের লোক। আবার তাদের অনেকেই স্বচ্ছল এবং স্বাবলম্বী।
নরসিংদী সদর উপজেলার নূরালাপুর ইউনিয়নের ছালেমা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন যাবত কোন কাজকর্ম করতে পারেনা। অসুস্থ স্বামী এবং তিনটি সন্তান নিয়ে মানুষের বাড়িতে ঝি এর কাজ করে অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছি।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সরকারের দেওয়া ঈদ উপহারের চাল আমাদের ভাগ্যে জোটেনি। যাদের সংসারে কোন অভাব নেই, তিন-চার জন উপার্জনক্ষম সদস্য রয়েছে তারাই পাচ্ছে সরকারের এই চাল।
মহিষাশুর ইউনিয়নের হতদরিদ্র বারেক মিয়া বলেন, আমরা চেয়ারম্যান, মেম্বারদের আত্মীয়-স্বজন বা কাছের লোক হতে পারিনি তাই প্রধানমন্ত্রীর উপহারের চাল পাইনি।
রায়পুরা উপজেলার মরজাল ইউনিয়নের দিনমজুর শুক্কুর আলী বলেন, ‘চাইলের লাইগ্গা মেম্বারের কাছে অনেক বার গেছি কিন্তু কোন পাত্তা দেয়নাই।’
জেলার প্রায় সকল পৌরসভা এবং ইউনিয়ন ঘুরে একই চিত্র দেখা যায়। কথা বলতে চেয়েও সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ভয়ে অনেকেই সটকে পড়েন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তির একই অভিযোগ যে চেয়ারম্যান, মেম্বার ও নেতাকর্মীদের দাপটের কাছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ অসহায়। তাদের কাছে গরীবের কোন মূল্য নেই।
এছাড়াও জেলার একটি ইউনিয়নে চাল ওজনে কম দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ নোমান বলেন, বরাদ্ধপত্রে সকল নির্দেশনা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে কিনা সেটা আমার জানা নাই। এ বিষয়টা উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভাল বলতে পারবে।