মোঃ শাহাদাৎ হোসেন রাজু
আজ রক্ত ঝড়া আগস্টের প্রথমদিন, আবার আগস্ট মাসকে আমরা শোকের মাসও বলে থাকি। এ মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে ইতিহাসের ভয়াবহতম হত্যাকাণ্ড ও নারকীয় গ্রেনেড হামলা। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধূর শোকের দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ককে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ২০০৪ সালের এ মাসেই গ্রেনেড হামলা করে জাতির জনকের কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।
সেদিন হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভ্রাতা শেখ আবু নাসের, জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেল, নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ও জাতির পিতার ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ ও কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে।
আগস্ট এলেই মনে পড়ে বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কিত এক অধ্যায়ের কথা। এক বেদনাবিধুর দিনের কথা। যে দিনটি বাঙালীর জন্য এক বুক কষ্টের কারণ। অসহ্য যে ব্যথাভার। তাই আগস্ট শোকাবহ।
ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাঙালি জাতি সে নিষ্ঠুর হত্যার বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত হলেও ঘাতকদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার চেতনাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে আগস্ট।
‘দ্য টাইমস অব লন্ডন’ এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়, বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।
জাতির পিতা তার সব অনুভূতি, ত্যাগ, সংগ্রাম, বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব, অদম্য স্পৃহা, দৃঢ় প্রত্যয়, বাঙালি জাতির প্রতি গভীর ভালোবাসা, মমত্ববোধ, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও আদর্শের দ্বারা সমগ্র বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা অর্জনের চুড়ান্ত আত্মত্যাগে দীক্ষিত করে তুলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্মলাভ, ’৪৮-এর মার্চে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলন, ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম, ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬-দফা, ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ১১-দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে ‘আওয়ামী লীগ’-এর নিরঙ্কুশ বিজয়সহ ইতিহাস সৃষ্টিকারী নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের চুড়ান্ত লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিশপথে ঐক্যবদ্ধ হয় বাঙালি জাতি। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী নেতৃত্বে পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গে উজ্জীবিত ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক। তিনি বাংলার মাটি ও মানুষের পরম আত্মীয়, শত বছরের ঘোর নিশীথিনীর তিমির বিদারী অরুণ, ইতিহাসের বিস্ময়কর নেতৃত্বের কালজয়ী স্রষ্টা, বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। বাঙালি জাতির পিতা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। উন্নত সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন সারথি।
সেদিন নরপিশাচ রূপি খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে ঘৃণ্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। দীর্ঘ ২১ বছর বাঙালি জাতি বিচারহীনতার কলঙ্কের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিয়মতান্ত্রিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০১০ সালে ঘাতকদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করে।
অন্যদিকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল জাতির পিতার কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধিদলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও এই ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী ও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন।
শোকাবহ আগস্টে পুরো জাতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ যথাযোগ্য মর্যাদা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভাবগম্ভীর আর বেদনাবিধূঁর পরিবেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতীয় শোক দিবস পালন করবে। প্রতিবারের মতো এবারো শোকার্ত বাঙালি জাতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আওয়ামী লীগ ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে নানা কর্মসূচি নিয়েছে। করোনা মহামারির সংক্রমণ রোধে সীমিত পরিসরে যথাযথ স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে মাসব্যাপী শোক দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, সমর্থক এবং সব সহযোগী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। সব সাংগঠনিক জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ডসহ সব শাখার নেতাদের জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর্মসূচি পালনের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
মাসব্যাপী কর্মসূচির আজ প্রথমদিন আগস্টের প্রথম প্রহরে রাত ১২টা ১ মিনিটে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণ অভিমুখে আলোর মিছিল করেছে। বিকেল ৩টায় যুবলীগ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মাসব্যাপী কুরআন খতমের প্রথম দিন কুরআন তেলাওয়াত করা হবে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অসহায়-দুস্থদের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ শুরু করা হবে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ভবনে রক্তদান ও প্লাজমা সংগ্রহ কর্মসূচি নিয়েছে কৃষক লীগ।